একবিংশ শতাব্দীর বিশ্বস্ত অংশীদারিত্ব হিসেবে বিবেচিত ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে প্রস্তুত।
রঞ্জিত কুমার: প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর আসন্ন যুক্তরাষ্ট্র সফর (১২-১৪ ফেব্রুয়ারি) কৌশলগত সম্প্রদায়ের নিবিড় পর্যবেক্ষণের আওতায় রয়েছে, কারণ এটি বিশ্বের দুই শীর্ষস্থানীয় গণতান্ত্রিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত হিসেবে দেখা হচ্ছে।
এই সফরটি এমন একটি সময়ে হচ্ছে যখন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ককে আরও উচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছেন। তার দ্বিতীয় মেয়াদের প্রথম মাসেই প্রধানমন্ত্রী মোদীকে আমন্ত্রণ জানানোর বিষয়টি এই বৈঠকের তাৎপর্যকে তুলে ধরে, যা অর্থনীতি, বাণিজ্য, প্রতিরক্ষা, মহাকাশ, পারমাণবিক শক্তি, সাইবার নিরাপত্তা, উন্নত প্রযুক্তি ও বিরল খনিজসহ বিভিন্ন খাতে গভীর সহযোগিতা বাড়ানোর উদ্দেশ্যে অনুষ্ঠিত হতে চলেছে।
মোদী-ট্রাম্প সম্পর্ক
প্রধানমন্ত্রী মোদী ও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ব্যক্তিগত সম্পর্ক এই অংশীদারিত্বকে আরও শক্তিশালী করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী মোদী আশাবাদী যে তার এই সফর ভারত-যুক্তরাষ্ট্র বন্ধুত্বকে আরও দৃঢ় করবে এবং পারস্পরিক সহযোগিতার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে।
এই সফরটি বিদ্যমান সম্পর্ককে আরও মজবুত করার পাশাপাশি নতুন ক্ষেত্রেও সহযোগিতার সুযোগ অনুসন্ধানের একটি সুযোগ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে, যা দুই দেশের মধ্যে আরও কৌশলগত ও বহুমাত্রিক অংশীদারিত্ব গড়ে তুলতে সহায়ক হবে।
ভারত-যুক্তরাষ্ট্র কৌশলগত সংযুক্তি
বিশ্ব রাজনীতির দ্রুত পরিবর্তনশীল প্রেক্ষাপটে, ঠান্ডা যুদ্ধের এক দশক পর দুই বিশ্বশক্তির ঘনিষ্ঠ হওয়া কৌশলগত পুনর্বিন্যাসের সূচনা করেছে।
চীন বর্তমানে এক জটিল অবস্থায় রয়েছে, কারণ তার প্রতিদ্বন্দ্বী ভারত যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠ হচ্ছে, যা জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে গঠিত কোয়াড জোটকে আরও শক্তিশালী করছে।
ভারত-যুক্তরাষ্ট্র কৌশলগত অংশীদারিত্ব মার্কিন রাজনৈতিক মহলে বরাবরই দ্বিদলীয় সমর্থন পেয়ে আসছে, কারণ ওয়াশিংটন ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতার গুরুত্ব উপলব্ধি করছে।
ভারতের পারমাণবিক শক্তি তার কৌশলগত মর্যাদাকে আরও বৃদ্ধি করেছে, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নাগরিক পারমাণবিক সহযোগিতা চুক্তির মাধ্যমে আরও শক্তিশালী হয়েছে।
২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ভারত সফরের সময় ভারত-যুক্তরাষ্ট্র কৌশলগত অংশীদারিত্বকে ‘গ্লোবাল কমপ্রিহেনসিভ স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারশিপ’-এর পর্যায়ে উন্নীত করা হয়।
চীনের আগ্রাসী কার্যকলাপের প্রেক্ষাপটে, বিশেষ করে দক্ষিণ চীন সাগর থেকে লাদাখ পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলে, ভারত শক্তিশালী কৌশলগত অংশীদারিত্বের গুরুত্ব উপলব্ধি করছে। একই সঙ্গে, যুক্তরাষ্ট্র চীনের উপর নির্ভরতা কমানোর জন্য ভারতকে একটি বিকল্প অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত অংশীদার হিসেবে দেখছে।
ভারত-যুক্তরাষ্ট্র প্রতিরক্ষা অংশীদারিত্ব
ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা সম্পর্ক তাদের কৌশলগত অংশীদারিত্বের অন্যতম প্রধান ভিত্তি।
গত কয়েক দশকে, যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে ২৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি মূল্যের উন্নত প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম সরবরাহ করেছে, যার মধ্যে অ্যাপাচি কমব্যাট হেলিকপ্টার, চিনুক হেভি-লিফট হেলিকপ্টার এবং সি গার্ডিয়ান ড্রোন অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
এই উন্নত সামরিক প্রযুক্তি ভারতের জন্য চীনের সীমান্তে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। মোদীর আসন্ন যুক্তরাষ্ট্র সফরের সময় ভারতীয় সেনাবাহিনীকে আরও উন্নত অস্ত্র ও প্রযুক্তি সরবরাহ নিয়ে আলোচনা হতে পারে।
এখন পর্যন্ত প্রতিরক্ষা সহযোগিতা মূলত ক্রেতা-বিক্রেতার সম্পর্কের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল, তবে এটি যৌথ উৎপাদনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে, যেখানে স্ট্রাইকার যান ও জ্যাভলিন অ্যান্টি-ট্যাঙ্ক মিসাইলের যৌথ উৎপাদন পরিকল্পনা আলোচনায় আসতে পারে।
ভারতের প্রতিরক্ষা সক্ষমতা বাড়াতে, দুই দেশ ২০১৫ সালে একটি নতুন প্রতিরক্ষা সহযোগিতা কাঠামো গ্রহণ করে, যা ১০ বছরের জন্য পুনর্নবীকরণ করা হয়। যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে ‘মেজর ডিফেন্স পার্টনার’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে, যা দুই দেশের মধ্যে নিয়মিত সামরিক আলোচনা ও যৌথ মহড়ার পথ প্রশস্ত করেছে।
ভারত-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্যিক সম্পর্ক
যুক্তরাষ্ট্র বর্তমানে ভারতের বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার, যেখানে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ প্রায় ১৯০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এছাড়া, যুক্তরাষ্ট্র ভারতীয় বাজারে তৃতীয় বৃহত্তম বিনিয়োগকারী, যার বিনিয়োগ ৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি।
ভারতের আধুনিক শিল্প অর্থনীতির জন্য উন্নত প্রযুক্তি ও বিরল খনিজ অপরিহার্য, যা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সহযোগিতার মাধ্যমে চীনের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে সহায়ক হবে।
উভয় দেশই গুরুত্বপূর্ণ ও উদীয়মান প্রযুক্তির ক্ষেত্রে সহযোগিতা বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে।
শেষ কথা
ভারত আশা করছে যে ট্রাম্প প্রশাসন অভিবাসন সংক্রান্ত নীতিগুলোকে যথাযথভাবে পরিচালনা করবে, যা উভয় অর্থনীতির জন্য উপকারী হবে। কারণ যুক্তরাষ্ট্রে দক্ষ ভারতীয় পেশাদারদের চাহিদা রয়েছে, আর ভারত তার মানবসম্পদ রপ্তানি থেকে লাভবান হয়।
চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) পাল্টা কৌশল হিসেবে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র ‘ইন্ডিয়া-মিডল ইস্ট-ইউরোপ করিডোর’ প্রকল্পের পরিকল্পনা করেছে, যা ভারতকে মধ্যপ্রাচকের মাধ্যমে ইউরোপের সঙ্গে যুক্ত করবে।
এই কৌশলগত উদ্যোগ ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ককে শুধু দ্বিপাক্ষিক পর্যায়েই নয়, বরং বিশ্ব শান্তি ও স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রে ইতিবাচক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবে।
প্রধানমন্ত্রী মোদী ও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প, যারা ব্যক্তিগতভাবে ভালো সম্পর্ক বজায় রেখেছেন, আরও কিছু নতুন পরিকল্পনা গ্রহণ করতে পারেন, যা দুই গণতন্ত্রকে বিশ্ব মঞ্চে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের সুযোগ দেবে।
লেখক: রঞ্জিত কুমার, সিনিয়র সাংবাদিক ও কৌশলগত বিশ্লেষক; এখানে প্রকাশিত মতামত তাঁর ব্যক্তিগত। সূত্র: ইন্ডিয়া নিউজ নেটওয়ার্ক