গত দশ বছরে প্রধানমন্ত্রী মোদীর নেতৃত্বে উপসাগরীয় অঞ্চলের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক আরও শক্তিশালী ও বহুমুখী হয়েছে।
ভারত ও উপসাগরীয় অঞ্চলের সম্পর্ক প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে অনেক বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। ভারতের জন্য উপসাগরীয় অঞ্চল তার ‘বর্ধিত প্রতিবেশী’, যেখানে দেশটির গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তাগত স্বার্থ রয়েছে। মোদীর নেতৃত্বে এই অঞ্চলের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক আরও সুদৃঢ় ও বহুমুখী হয়ে উঠেছে।

মোদী শাসনামলে উপসাগরীয় নেতাদের ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করার আগ্রহ উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, যা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে আরও কার্যকর ও স্থিতিশীল করে তুলেছে। পাশাপাশি, ভারত ও উপসাগরীয় দেশগুলোর মধ্যে উচ্চ পর্যায়ের সফরের সংখ্যাও ক্রমবর্ধমান হারে বেড়েছে।

এই প্রেক্ষাপটে, কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল-থানির সাম্প্রতিক ভারত সফর ভারত-উপসাগর সম্পর্কের এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। ভারত ও কাতার তাদের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে কৌশলগত পর্যায়ে উন্নীত করার বিষয়ে সম্মত হয়েছে। একই সঙ্গে, ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে প্রধানমন্ত্রী মোদীর কুয়েত সফরের সময় ভারত ও কুয়েতের মধ্যে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে।

ভারতের ‘থিংক ওয়েস্ট’ নীতি
মোদী শাসনামলে ভারত উপসাগরীয় অঞ্চলের প্রতি আরও সক্রিয় ও বাস্তবসম্মত দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেছে। এই লক্ষ্যে ভারত ‘থিংক ওয়েস্ট’ নীতি গ্রহণ করেছে, যা অঞ্চলের সঙ্গে সম্পর্ককে আরও সুসংহত করার জন্য বিশেষভাবে গৃহীত হয়েছে।

এই নীতির আওতায় শুধু প্রচলিত দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ও জ্বালানি খাতের সম্পর্ক জোরদার করা হচ্ছে না, বরং নবায়নযোগ্য জ্বালানি, জলবায়ু পরিবর্তন, সংযোগ বৃদ্ধি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা এবং কৌশলগত অংশীদারিত্বের মতো নতুন সহযোগিতার ক্ষেত্রও অনুসন্ধান করা হচ্ছে।

প্রধানমন্ত্রী মোদীর উপসাগরীয় নীতি শুধুমাত্র ঐতিহ্যগত ক্রেতা-বিক্রেতা সম্পর্কের বাইরে গিয়ে আরও শক্তিশালী কৌশলগত অংশীদারিত্ব গড়ে তোলার ওপর গুরুত্ব দেয়।

উপসাগরীয় অঞ্চলের সঙ্গে কৌশলগত অংশীদারিত্ব জোরদার করা ভারতের জন্য বিস্তৃত পশ্চিম এশিয়া ও আরব-ইসলামী বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রেও সহায়ক হবে।

বাণিজ্য ও জ্বালানি
বাণিজ্য ও জ্বালানি সহযোগিতা দীর্ঘদিন ধরে ভারত ও উপসাগরীয় অঞ্চলের সম্পর্কের প্রধান স্তম্ভ হিসেবে রয়েছে। দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ধারাবাহিকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে, যেখানে সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং সৌদি আরব ভারতের শীর্ষ বাণিজ্য অংশীদার হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। ২০২৪ সালে, এই দুই দেশের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্যের পরিমাণ যথাক্রমে ৮৪.৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং ৫২.৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে।

এটি ভারত ও উপসাগরীয় অঞ্চলের মধ্যে ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক সম্পর্কের প্রতিফলন। ভারত বর্তমানে উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদের (জিসিসি) সঙ্গে একটি মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) নিয়ে আলোচনা করছে, যা চূড়ান্ত হলে বাণিজ্য ও ব্যবসাকে আরও এগিয়ে নেবে। ২০২২ সালে, ভারত সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গে একটি বিস্তৃত অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব চুক্তি (সিইপিএ) স্বাক্ষর করেছে, যা অর্থনৈতিক সহযোগিতাকে আরও শক্তিশালী করেছে। বর্তমানে, জিসিসি ভারতের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য ব্লক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।

ভারত তার জ্বালানির চাহিদার জন্য উপসাগরীয় অঞ্চলের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল, যেখানে এই অঞ্চল দেশটির মোট জ্বালানি চাহিদার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ সরবরাহ করে। ইরাক, সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত ভারতের প্রধান অপরিশোধিত তেল সরবরাহকারী দেশ, আর কাতার ভারতের প্রধান তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) সরবরাহকারী দেশ হিসেবে রয়েছে।

এছাড়া, উপসাগরীয় দেশগুলো ভারতের কৌশলগত পেট্রোলিয়াম রিজার্ভ (এসপিআর) ব্যবস্থাপনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে, যা ভারতের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। প্রচলিত ক্রেতা-বিক্রেতা সম্পর্কের বাইরে গিয়ে ভারত এখন উপসাগরীয় অঞ্চলের জ্বালানি খাতে কৌশলগত অংশীদারিত্ব গড়ে তুলছে এবং বিনিয়োগ করছে।

ভারতের বিভিন্ন কোম্পানি উপসাগরীয় অঞ্চলে তেল অনুসন্ধান, উৎপাদন এবং পাইপলাইন প্রকল্পে যুক্ত হয়েছে, যা জ্বালানি সহযোগিতার ক্ষেত্রে একটি গভীরতর পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়।

প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, ভারত ও উপসাগরীয় দেশগুলোর সম্পর্ক ঐতিহ্যগত সহযোগিতার ক্ষেত্রের বাইরে প্রসারিত হয়েছে। মোদীর শাসনামলে ভারতের উপসাগরীয় অঞ্চলের সঙ্গে প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা ক্ষেত্রে সহযোগিতা গভীরতর হয়েছে।

ভারত ইতোমধ্যে সৌদি আরব, ওমান, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং কুয়েতের সঙ্গে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। যৌথ সামরিক মহড়া, প্রশিক্ষণ কর্মসূচি এবং কৌশলগত সংলাপ সামরিক বাহিনীগুলোর মধ্যে সম্পর্ককে আরও শক্তিশালী করেছে।

যদিও ভারতীয় নৌবাহিনী ঐতিহ্যগতভাবে উপসাগরীয় অঞ্চলের সঙ্গে প্রতিরক্ষা সহযোগিতার নেতৃত্ব দিয়ে এসেছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সেনাবাহিনী, বিমান বাহিনী এবং উপকূলরক্ষী বাহিনীও যৌথ মহড়া ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রমে অংশগ্রহণ বৃদ্ধি করেছে।

উভয় পক্ষ সন্ত্রাসবাদ, উগ্রবাদ এবং সামুদ্রিক জলদস্যুতার মতো আন্তঃসীমান্ত নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার গুরুত্ব অনুধাবন করছে। বর্ধিত গোয়েন্দা তথ্য আদান-প্রদান ও তথ্য বিনিময় এই ধরনের হুমকি মোকাবিলায় যৌথ প্রচেষ্টাকে আরও কার্যকর করেছে।

বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে সন্ত্রাসী সন্দেহভাজনদের ভারতে প্রত্যর্পণ নিরাপত্তা সহযোগিতার ক্রমবর্ধমান সফলতার প্রতিফলন ঘটায়।

নতুন সহযোগিতার ক্ষেত্র
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে ভারত ও উপসাগরীয় অঞ্চলের মধ্যে বেশ কয়েকটি নতুন ও উদীয়মান সহযোগিতার ক্ষেত্র জোরদার হয়েছে। ভারতের উপসাগরীয় অঞ্চলের সঙ্গে সহযোগিতা ও সম্পৃক্ততার মধ্যে নবায়নযোগ্য জ্বালানি যেমন সবুজ হাইড্রোজেন, বায়ু ও সৌরশক্তি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

এর পাশাপাশি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, কৃষি, খাদ্য নিরাপত্তা এবং স্বাস্থ্যসেবা গুরুত্বপূর্ণ সহযোগিতার ক্ষেত্র হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। সংযোগ উভয় পক্ষের জন্য আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র। চাবাহার বন্দর ব্যবহার করে ভারত আফগানিস্তান ও মধ্য এশিয়ার সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে পারে, যা উপসাগরীয় অঞ্চলের জন্যও কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ।

২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত জি২০ শীর্ষ সম্মেলনের সময় ভারত ‘ইন্ডিয়া–মিডল ইস্ট–ইউরোপ ইকোনমিক করিডর’ (আইএমইসি) প্রকল্পে স্বাক্ষর করেছে। এই করিডরটি ভারত, উপসাগর এবং ইউরোপকে সমুদ্র, রেল ও সড়কপথে সংযুক্ত করবে, যা বাণিজ্য ও সংযোগকে আরও শক্তিশালী করবে। সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত আইএমইসি-এর প্রধান উপসাগরীয় অংশীদার।

ভারত, ইসরায়েল, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে গঠিত ‘আই২ইউ২ ক্ষুদ্র গোষ্ঠী-এ ভারতের অংশগ্রহণও নতুন ও উদীয়মান বিষয়গুলোর ওপর সহযোগিতার একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ। এতে জ্বালানি, খাদ্য নিরাপত্তা এবং প্রযুক্তি সহযোগিতার ক্ষেত্রে পারস্পরিক কার্যক্রম বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে।

২০২৩ সালে ভারতের জি২০ সভাপতিত্বের সময় ভারত ওমান ও সংযুক্ত আরব আমিরাতকে আমন্ত্রিত দেশ হিসেবে জি২০ বৈঠকে অংশগ্রহণের সুযোগ করে দেয়। এটি দ্বিপাক্ষিক এবং বৈশ্বিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ক্রমবর্ধমান কৌশলগত সংহতি ও গভীর সহযোগিতাকে তুলে ধরে।

উপসাগর এবং পশ্চিম এশিয়ার সঙ্গে ভারতের সম্পৃক্ততা মোদীর শাসনামলে ভারতের পররাষ্ট্রনীতির অন্যতম সাফল্য হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। প্রচলিত ক্ষেত্র যেমন বাণিজ্য ও জ্বালানির ক্ষেত্রে অগ্রগতি ধরে রাখার পাশাপাশি, ভারত নতুন ও উদীয়মান খাতেও সহযোগিতার পরিধি সম্প্রসারিত করেছে।

উপসংহার
উপসাগরীয় শাসকদের মধ্যে ভারতের প্রতি পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং ভারত সম্পর্কে নেতাদের ও সাধারণ নাগরিকদের দৃষ্টিভঙ্গিতে দৃশ্যমান পরিবর্তন এসেছে। ভারতকে এখন একটি স্থিতিশীল গণতন্ত্র ও বৃহৎ অর্থনীতির দেশ হিসেবে দেখা হয়, যার বৈশ্বিক পরিসরে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান রয়েছে। ভারত উপসাগরীয় অঞ্চলে আঞ্চলিক ও অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে নিরপেক্ষতা ও অপ্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপের নীতি বজায় রেখেছে।

পশ্চিম এশিয়ার জটিল ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা সত্ত্বেও, ভারত সফলভাবে ইরান, ইসরায়েল এবং উপসাগরীয় আরব রাষ্ট্রসহ সকল প্রধান অংশীদারের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে। এমন ভারসাম্যপূর্ণ ও বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গি শুধু উপসাগরীয় অঞ্চলে নয়, বরং সমগ্র আরব-ইসলামিক বিশ্বে ভারতের অবস্থানকে আরও সুদৃঢ় করেছে।

লেখক: মানোহর পাররিকর ইনস্টিটিউট ফর ডিফেন্স স্টাডিজ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস, নয়াদিল্লির একজন গবেষণা ফেলো। এই লেখায় প্রকাশিত মতামত সম্পূর্ণ তার ব্যক্তিগত। সূত্র: ইন্ডিয়া নিউজ নেটওয়ার্ক